সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
শিক্ষা

ঢাবির গেস্টরুম গণরুমে বন্দী মেধার আর্তচিৎকার

মুহাম্মদ ওমর ফারুক ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০১:০২ পি.এম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের মূর্তিয়মান একটি আতঙ্কের নাম গেস্টরুম। নাম গেস্টরুম বা অতিথিশালা হলেও এখানে কোনো আপ্যায়ন হয়না। বরং মানসিক অত্যাচারের পাশাপাশি শারিরীক অত্যাচারও হয়। ম্যানার শিক্ষানোর নামে শিক্ষার্থীদের সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করা হয়।
এই অত্যাচারের সবচেয় বেশি শিকার হয় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। সরাসরি মফস্বল থেকে উঠে আসা অনেক শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। যাদের বেশিরভাগেরই আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে না। ফলে ছত্রলীগের অমানবিক গণরুমই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে দাড়ায়। 
কিন্তু গণরুমে থাকার মূল্য হিসেবে তাকে ফুলটাইম রাজনৈতিক গোলাম হয়ে থাকতে হয়। দৈনিক কমপক্ষে একবার  গেস্টরুমে হাজিরা দিতে হয় যেখানে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করে সারাদিনের কর্মকান্ডের জবাবদিহি করতে হয়। কোনো রকমের প্রোগ্রাম ছাড়াই মধুর কেন্টিন এবং হাকিম চত্বরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকতে হয় শুধু নেতাকে প্রটোকল দেওয়ার জন্য।
গেস্টরুমে অকথ্য ভাষায় গালাগালি আর কথায় কথায় হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি নিত্যদিনের ঘটনা ছিলো। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিলো ট্যাগিংয়ের। কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের কারো কোনো ক্ষোভ থাকলে ফসানো হতো শিবির ট্যাগিংয়ে। শিবির ট্যাগ দিয়ে, গায়ে হাত তোলা, রড দিয়ে পেটানো এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার অসংখ্য নজির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আছে।
শিবির ট্যাগিংয়ের শিকার হয়ে নির্যাতিত ঢাবির সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ মনসুর বলেন, একদিন রাতে পেপার রুমে ছিলাম।রাত ১২ টার দিকে আমার বন্ধু রিফাতের ফোন আসে ২৩৬ নাম্বার রুমে যাওয়ার জন্য।
তো আমি সেখানে যাই স্বাভাবিক ভাবেই। দরজার সামনে দাড়ায়ে বুজতে পারি ভিতরে কয়েকজন গালাগালি ও চিল্লাচিল্লি করছে।তারপর আমাকে ভিতরে নেওয়া হয়,ভিতরে ঢুকেই দেখি সবাই রড়,লোহার পাইপ এসব নিয়ে বসে আছে,আর রিফাত কে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করছে। আমি যাওয়ার সাথেই আমার মোবাইল তারা নিয়ে নেয় এবং চেক করতে শুরু করে। হঠাৎ তারা আমাকে বলে আমি মাদ্রাসায় পড়েছি কি না আর ফোকাসে কোচিং করেছি কি না।ফোকাস পরিচালকের নাম কি এইসব প্রশ্ন করে। 
আমি উত্তর দিয়ে যাই।তখন আমাকে বলা হয় তুই মাদ্রাসায়ও পড়লি আবার ফোকাসেও কোচিং করলি তুই শিবির করিস।এভাবে একসময় রিফাতকে বের করে দিয়ে আমাকে একাই রেখে দেয়।একটা সময়ে লাইট অফ করে বলে সব শিবিরের নাম বলতে। অথচ আমি কোন কালেই কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না। বারবার না বলতে বলতে একটা রডের বারি এসে পড়ে আমার পিঠে। লাইট অফ অবস্থায়। পরে লাইট অন হলে আমি আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র সাজিদের হাতে লোহার পাইপ দেখতে পাই।শেষে সাজিদ আমাকে ৬ তলা থেকে ফেলে দেয়ার জন্য উদ্যত হয়, কিন্তু তার ব্যাচমেটরা (আমার কিছু অসহায় সিনিয়র)  তাকে থামানোর চেষ্টা করে।
সে রাতে ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত এই টর্চারের পর আমাকে রুম থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।

ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মো: আবু হুরাইরা বলেন,  সত্যি বলতে, এটা বলার কোনো অবকাশই রাখে না যে গেস্টরুম-গণরুম কালচারটা স্টুডেন্টদের জন্য জঘন্য অভিশাপ ছিল। আর এটাও বলা বাহুল্য যে,আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারি নাই যে এটা থেকে মুক্তি পাবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকাতে আসে আবার অনেকের আর্থিক সংকটের কারণে বাইরে বা মেসে থেকে পড়াশোনা করা তার জন্য কঠিন অনেকাংশে সম্ভবই হয়ে ওঠে না । তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে। 
ছাত্রলীগ সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে সেচ্ছাচারীর মতো স্টুডেন্টদেরকে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আমরা পুরোপুরি বাধ্য হয়েই সেগুলো মেনে নিয়েছি যে সবাই পারলে আমি কেন পারবো না। যদিও আমরা এক রুমে ২০-২৫ জনও থেকে রাত যাপন করেছি। ছাত্রলীগের নেতারা আমাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করত যে তারা আমাদেরকে রুম বরাদ্দ দেয় এমনকি নাকি তারা নিজেরা রুমে না থেকেই আমাদেরকে রুমে থাকার সুযোক করে দেয়। কিন্তু বাস্তব দৃশ্যপট টা ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত।  কোনো কোনো দিন টিউশনি থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যেত যার ফলে মাঝেমাঝে সময়মতো গেস্টরুমে থাকতে পারতাম না বা গেস্টরুমে উপস্থিত হতে একটু দেরি হয়ে যেত ।  ফলাফলস্বরূপ নিজের উপর চলত অকাট্য গালিগালাজসহ নির্যাতনের স্ট্রিম রুলার ।  প্রথম বর্ষটা এভাবেই কেটেছে আর দিন শেষে সিজিপিএ -এর বেহাল দশা। অবশেষে, আলহামদুলিল্লাহ যে আমরা এখন স্বাধীন কিন্তু এই স্বাধীনতা যে কতদিন আমরা ধরে রাখতে পারব সেটা আরেকটা চরম উদ্বেগের বিষয়।
ঢাবির মহাসিন হলের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান বায়জিদ বলেন,  গেস্ট রুমে ম্যানার শেখানো নামে গালি ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করা হয়। কোনো ভাইকে সালাম না দিলে অশালীন ভাষায় বকা- বকি করা হয়। প্রোগ্রাম না গেলে হল ছাড়াতে বাধ্য করা হয়।
গত ৫ ই আগস্ট তারিখ  সরকার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ  দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট রুম ও গণরুম প্রথার পতন ঘটে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলে বৈধ সিট বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে এবং গেস্ট রুম কালচারের বিলুপ্তির হয় । 
গেস্ট রুম কালচারের বিলুপ্তির ফলে এখন একজন শিক্ষার্থী হল কেন্দ্রিক সকল চাপ থেকে মুক্ত হয়েছে এবং তাদের প্রতিদিনের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
গেস্ট রুমের তিক্ততা আসলে অকথ্য। এর মাধ্যমে  একজন শিক্ষার্থীকে শারীরিক,মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হতো। একসাথে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি একজন শিক্ষার্থীকে তার হল জীবনকে দুর্বিষহ করে।


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

চীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈঠক

news image

ঢাবিতে জুলাই স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত

news image

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ম্যাটেরিয়ালস রিসার্চ সোসাইটি’র ঢাবি স্টুডেন্ট চ্যাপ্টারের যাত্রা শুরু

news image

ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ পেলেন শাবির ১ শিক্ষক ও ৭ শিক্ষার্থী

news image

শাবিপ্রবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের

news image

ঊর্মিকে আজীবন নিষিদ্ধের পাশাপাশি তার সনদ বাতিলের দাবি শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের

news image

শাবিপ্রবিতে ভিসি আসার পরপরই অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ নিয়োগ

news image

আইএইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রথম কার্যদিবস

news image

শাবিপ্রবিতে নিয়োগ পেলো নতুন উপাচার্য

news image

অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পাসে মন্দির বানাচ্ছে শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা

news image

ঢাবির গেস্টরুম গণরুমে বন্দী মেধার আর্তচিৎকার

news image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান

news image

ঢাবির উর্দু বিভাগের তিন শিক্ষকের অব্যাহতির দাবি বিভাগের শিক্ষার্থীদের

news image

আগামীকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ

news image

বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনের জন্য কি কি যোগ্যতা লাগে?

news image

ঢাবির শিশু শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপনের জন্য দায়ী ক্যান্টিন মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

news image

বদলে যাচ্ছে পরীক্ষা পদ্ধতি, পরবর্তী বছর থেকে এসএসসি পরীক্ষা হবে ৫ ঘন্টার।

news image

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্গাপুর উপজেলা সংগঠনের নেতৃত্বে মোবারক ও বিল্লাল